
মোঃ বেলাল হোসেনঃ
কুতরবানির ইতিহাসঃ
কুরবানির ইতিহাস আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) সময় থেকেই প্রচলিত ছিল।
কুরবানী করা আল্লাহর এক ইবাদত। আর কুরআন ও সুন্নাহয় এ কথা প্রমাণিত যে, কোন আমল নেক,সালেহ বা ভালো হয় না, কিংবা গৃহীত ও নৈকট্যদানকারী হয় না, যতক্ষণ না তাতে দু’টি শর্ত পূরণ হয়েছে। ১
ইখলাস। অর্থাৎ,তা যেন খাঁটি আল্লাহরতই উদ্দেশ্যে হয়। তা না হলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। যেমন কাবীলের নিকট থেকে কুরবানী কবুল করা হয়নি এবং তার কারণ সবরূপ হাবীল বলেছিলেন,
আরবি অর্থাৎ, আল্লাহ তো মুত্তাক্বী (পরহেযগার ও সংযমী)দের কুরবানীই কবুল করে থাকেন।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,আরবি,
অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে কখনোও ওগুলির গোশত পৌঁছে না এবং রক্তও না বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া (সংযমশীলতা) এভাবে তিনি ওগুলিকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এই জন্য যে, তিনি তোমাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন। আর তুমি সুসংবাদ দাও সৎকর্মশীলদেরকে।
পরবর্তীতে কুরবানীর ইতিহাসের মধ্যে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর মধ্যে যে ঘটনার অবতারণা হয়েছে তাই হলো মহান স্মরণীয় ইতিহাস।
হযরত ইব্রাহিম খলিল (আঃ) মহান প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করলেন,
হে আমার প্রতিপালক আমাকে সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করুন। অতঃপর আল্লাহ তাকে একটা সন্তান দিলেন সে (সন্তান) যখন তার পিতার সাথে কাজ করার মত বয়সে উপনীত হলো তখন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) বললেন হে আমার পুত্র আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আল্লাহ রাস্তায় যবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কি বল,সে বললো হে আমার পিতা আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অর্ন্তভূক্ত পাবেন। যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং তিনি হযরত ইব্রাহীম(আঃ) তাকে (পুত্র)কে কাত করে (কুরবানী করার জন্যে) শোয়ালেন তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম হে ইব্রাহীম! তুমি তো স্বপ্নের আদেশ সত্যিই পালন করলে।এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে। আমি এটা (তার আদর্শ) পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি।
(সূরা আল সাফ্ফাত আয়াত ১০০-১০৮)।
প্রকৃত পক্ষে কুরবানী এমন এক সংকল্প, দৃঢ় বিশ্বাস, আত্মসমর্পণ ও জীবন দেয়ার বাস্তব বহি প্রকাশ যে মানুষের কাছে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহর এবং তাঁরই পথে তা উৎসর্গীকৃত হওয়াকে কুরবানি বুঝায়। এটা এ সত্যেরও নিদর্শন যে আল্লাহর ইংগিত হলেই বান্দাহ তাঁর রক্ত দিতে দ্বিধা করে না। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) মূলত তা-ই প্রমাণ করলেন। বস্তুত এভাবে আত্মসমর্পণ ও জীবন বিলিয়ে দেয়ার নামই হলো ঈমান, ইসলাম ও ইহসান।
কুরবানীর পশু খুব সুন্দর রিষ্ট-পুষ্ট হওয়া। জবেহ করার পূর্বে ছুরিতে ধার দিয়ে নেয়া। জবেহ করার পর প্রাণ বের হয়ে গেলে হাত পা কেটে চামড়া ছাড়ানো। জবেহ করার পদ্ধতি নিজের কুরবানী নিজে করা উত্তম। জবেহ করতে না জানলে জবেহ করার সময় উপস্থিত থাকা উত্তম।
কুরবানীর পশু মুসলমানের দ্বারা জবেহ করাঃ
কুরবানীর পশু মুসলমানের দ্বারা জবেহ করাতে হবে। কোনো অগ্নিপূজক অথবা কাফের ও মুশরিক দ্বারা জবেহ করলে কুরবানী হবেনা। বরং উক্ত পশুকে হারাম এবং মৃত মনে করতে হবে। কাফেরের সাহায্য নিয়ে কুরবানী করলে কুরবানী হয়ে যাবে কিন্ত মাকরূহ হবে (বাহারেশরীয়ত)।
কুরবানির মাংস বন্টনঃ
কুরবানীর মাংস নিজে খেতে পারে অথবা কোনো গরীব এবং কোন ধনীকেও প্রদান করতে পারে। কুরবানী দাতার জন্য কুরবানী মাংস খাওয়া মুস্তাহাব। কুরবানীর মাংস তিন অংশ করা মুস্তাহাব। একাংশ প্রতিবেশি গরীব মিসকিনের জন্য, একাংশ আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং এক অংশ নিজের খাওয়ার জন্য রাখতে পারেন। একাংশের কম দান করা উচিৎ নয়। সমস্ত মাংস সাদকা করে দেয়া জায়েজ। অনুরূপ সমস্ত মাংস নিজের জন্য রেখে দেয়াও জায়েজ। তিন দিনের অধীক কুরবানীর মাংস রেখে খাওয়া জায়েজ। যদি কুরবানী দাতা গরীব হয় এবং সংসারে অনেক মানুষ থাকে,এবং অভাব গুরুস্ত হয় তাহলে নিজের বাড়ির জন্য সমস্ত মাংস রেখে খাওয়া জায়েজ। (আলমগীরি)।
যদি কুরবানী মান্নতের হয়, তাহলে কুরবানী দাতা গরীব হলে ও নিজে খেতে পারবেনা এবং কোনো ধনীকেও খাওয়াতে পারবেনা। বরং সমস্ত মাংস সাদকা করে দেয়া ওয়াজিব,( বাহারে শরীয়ত)।
মৃত ব্যক্তির পক্ষ হতে কুরবানীঃ
মৃত ব্যক্তির পক্ষ হতে কুরবানী করলে তার মাংস নিজে খেতে পারে। ধনী ও গরীব সবাইকে খাওয়াতে পারে। তিন অংশ করতে পারে। প্রয়োজনে সমস্ত মাংস নিজের জন্য রাখতে পারে। অবশ্য মৃত ব্যক্তি যদি তার পক্ষ হতে কুরবানী করার জন্য অসীয়ত করে যায়, তাহলে সমস্ত মাংস সাদকা করতে হবে। (রদ্দুল মুহতার)
কুরবানীর চামড়া কি করবেনঃ
কুরবানীর চামড়া এবং তার দড়ি ইত্যাদি সমস্ত জিনিস সাদকা করতে হবে। কুরবানীর চামড়া বিক্রয় না করে নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারে। যথাঃ নামাজের মুসাল্লা, মশক, থলী ইত্যাদি করা জায়েজ (দুররে মুখতার)।
কুরবানী চামড়া দ্বারা নিজের কোনো প্রয়োজনীয় জিনিষ তৈরি করলে তা ভাড়ায় দেয়া জায়েজ। যদি ভাড়ায় দিয়ে থাকে তাহলে সেই পয়সা সাদকা করতে হবে। (রদ্দুল মুহতার)।
কুরবানী চামড়ার পরিবর্তে কোরআন শরীফ ও কিতাব নেয়া জায়েজ। (দুররে মুখতার)।
কুরবানীর চামড়া অথবা তার পয়সা এক ব্যক্তিকে অথবা একাধিক ব্যক্তিকে সাদকা করা জায়েজ। কুরবানীর চামড়া অথবা পয়সা দ্বীনি মাদ্রাসা দেয়া জায়েজ।
কুরবানী করার পূর্বে পশুর বাচ্চা হয়ে গেলে বাচ্চাকেও জবেহ করে দিতে হবে। যদি বাচ্চাকে বিক্রয় করে থাকে তাহলে তার পয়সা সাদকা করে দিতে হবে। যদি জবেহ করা না হয় বা বিক্রয় করা না হয় এবং কুরবানীর দিনগুলো অতিক্রম হয়ে যায় তাহলে জীবিত অবস্থায় সাদকা করে দিতে হবে। যদি কিছুই করা না হয় এবং পরের বৎসর তাকে কুরবানী করে থাকে তাহলে কুরবানী জায়েজ হবে না। পুনরায় কুরবানী করতে হবে। উক্ত জবেহ করা সমস্ত মাংস সাদকা করতে হবে (আলমগিরী)।
কুরবানী করার পর পেট থেকে যদি জীবিত বাচ্চা বের হয় তাহলে তাকে জবেহ করে খাওয়া জায়েজ। যদি মরা বাচ্চা বের হয় তাহলে তা খাওয়া হারাম (হিদায়া ও বাহারে – শরিয়াত)।
হে নবী মুহাম্মদ, আপনি বলুন, আমার নামায আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্যে। তাঁর কোন শরীক নেই, এ নির্দেশই আমাকে দেয়া হয়েছে আর আমি হলাম সবার আগে তাঁর অনুগত বান্দা। (সূরা আনআম: (১৬২-৬৩)।
পশু যেন নিম্নোক্ত ত্রুটিসমূহ থেকে মুক্ত হয়ঃ
যে প্রাণী লেংড়া অর্থ্যাৎ যা তিন পায়ে চলতে পারে-এক পা মাটিতে রাখতে পারে না বা রাখতে পারলেও ভর করতে পারে না এমন পশু দ্বারা কোরবানি হবে না। যে পশুর একটিও দাঁত নেই তার দ্বারা কোরবানি হবে না।
যে পশুর কান জন্ম হতে নেই সে পশুদ্বারা কোরবানি জায়েয নয়।
যে পশুর শিং মূল থেকে ভেঙ্গে যায় তা দ্বারা কোরবানি বৈধ নয়। তবে শিং উঠেইনি বা কিছু পরিমাণ ভেঙে গিয়েছে এমন পশু দ্বারা কোরবানি জায়েজ আছে।
যে পশুর উভয় চোখ অন্ধ বা একটি চোখের দৃষ্টি শক্তি এক তৃতীয়াংশ বা তার বেশি নষ্ট তা দ্বারা কুরবানি জায়েজ নেই।
যে পশুর একটি কান বা লেজের এক তৃতীয়াংশ কিংবা তার চেয়ে বেশি কেটে গিয়েছে তা দ্বারা কুরবানি সঙ্গত নয়।
বন্ধ্যা পশু কোরবানি করা জায়েজ আছে।
এ ব্যাপারে আল্লাহর রসূল (সা.) বলেন,চার রকমের পশু কুরবানী বৈধ বা সিদ্ধ হবে না
১-এক চোখে স্পষ্ট অন্ধত্ব।২-স্পষ্ট ব্যাধি।৩ – স্পষ্ট খঞ্জতা।৪- অন্তিম বার্ধক্য।
কুরবানীর পশু যেন সেই শ্রেণী বা বয়সের হয় যে শ্রেণী ও বয়স শরীয়ত নির্ধারিত করেছে। আর নির্ধারিত শ্রেণীর পশু চারটি; উঁট,গরু,ভেঁড়া ও ছাগল। অধিকাংশ উলামাদের মতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কুরবানী হল উঁট,অতঃপর গরু,তারপর মেষ (ভেঁড়া), তারপর ছাগল।
একটি উঁটে ১০ জন এবং গরুতে সাত ব্যক্তি কুরবানীর জন্য শরীক হতে পারে।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, এক ভ্রমণে আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাথে ছিলাম। এরকম পরিস্থিতিতে কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হল। তখন আমরা একটি গরুতে সাতজন অংশীদার হয়ে এবং একটি উটে ১০ জন অংশীদার হয়ে কুরবানী আদায় করলাম। জামে’ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ১৫০১।
জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা হুদাইবিয়া নামক জায়গাতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাথে একটি উটে সাতজন অংশীদার হয়ে এবং একটি গরুতেও সাতজন অংশীদার হয়ে কুরবানী সম্পন্ন করেছি।
এ হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহীহ্ বলেছেন। এ হাদীস অনুসারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অভিজ্ঞ সাহাবী ও অন্যান্য আলিমগণ আমল করেছেন। একই অভিমত সুফিয়ান সাওরী, ইবনুল মুবারাক, শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাকের (সাতজন পর্যন্ত উট-গরুতে অংশীদার হওয়া যায়)। ইসহাক (রহঃ) আরো বলেন, দশজন মানুষও একটি উটে অংশীদার হতে পারে। তিনি ইবনু আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীসকে তার এ মতের সমর্থনে দলীল হিসাবে উল্লেখ করেন।
জামে’ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ১৫০২
সাত ব্যক্তি মিলিত ভাবে কুরবানীর জন্য গরু ক্রয় করার পর তাদের কেউ একজন ইন্তেকাল করলে তার ওয়ারিসগণের অনুমতিতে কুরবানী করলে সবার পক্ষ হতে কুরবানী জায়েজ হয়ে যাবে। ওয়ারিসগণের বিনা অনুমতিতে করলে কারো কুরবানী জায়েজ হবে না। অংশীদারদের মধ্যে কেহ কাফের থাকলে অথবা কারো উদ্দেশ্য কুরবানী না হয়ে কেবল মাংস খাওয়া হলে কারো কুরবানী হবে না (দুররে মুখতার ও রদ্দুল মুহতার)।
বয়সের দিক দিয়ে উঁটের পাঁচ বছর,গরুর দুই বছর এবং মেষ ও ছাগের এক বছর হওয়া জরুরী। অবশ্য অসুবিধার ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী মেষ কুরবানী করা যায়। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, দাঁতালো ছাড়া যবেহ করো না। তবে তা দুর্লভ হলে ছয় মাসের মেষ যবেহ কর।
বয়স যদি কিছু কমও হয় কিন্তু এমন মোটা তাজা যে, এক বৎসর বয়সীদের মধ্যে ছেড়ে দিলেও তাদের চেয়ে ছোট মনে হয় না, তাহলে তার দ্বারা কোরবানি জায়েজ আছে।
যদি কুরবানীর পশু হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়,তবে তার পরিবর্তে অন্য কুরবানী যরূরী নয়। যদি ঐ পশু ঈদুল আযহার দিন বা পরে পাওয়া যায়, তবে তা তখনই আল্লাহর রাহে যবহ করে দিতে হবে। যদি কুরবানীর পূর্বে কুরবানী দাতা মৃত্যুবরণ করেন এবং তার অবস্থা এমন হয় যে,ঐ পশু বিক্রয়লব্ধ পয়সা ছাড়া তার ঋণ পরিশোধের আর কোন উপায় নেই,তখন কেবল ঋণ পরিশোধের স্বার্থেই কুরবানীর পশু বিক্রয় করা যাবে।
এ কুরবানী শুধু জীবনে কোন এক সময়ের জন্যে নয়, বরং প্রতি বছরই এ কুরবানী করতে হয়,হযরত নবী করিম (সাঃ) এর আমল থেকেই তা সুপ্রমাণিত। হযরত উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত।
রাসূলে করিম হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদীনায় দশ বছর অবস্থান করেছেন এবং প্রতি বছরই কুরবানী করেছেন। (তিরমিযী)।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে কুরবানী করার তাওফীক ও শক্তি দান করুন, আমিন।
/মোঃ বেলাল হোসেন /