
রৌমারী উপজেলা চর শৌলমারী এলাকায় জিম্মি হত্যার একটি ছোট্ট গল্প
সাংবাদিক বেলাল হোসেন রৌমারী
মেয়েটির নাম মমতাজ আক্তার জিম্মি বাবার নাম শাহাআলম প্রামানিক। গ্রামের নাম ঘুঘুমারির চর,ইউনিয়নের নাম চর শৌলমারী উপজেলা রৌমারী জেলা কুড়িগ্রাম। ছোট বেলায় জিম্মি তার মাকে হারায় তার বাবা তাকে খুব আদর যত্নে বড় করে তুলে। প্রত্যন্ত এই গ্রামেও শিক্ষার আলো এসেছে, সেই আলোর স্পর্শ পেতে সে নিজেও স্কুলে যায়। প্রাইমারীস্কুল পাস করে ভর্তি হয় পাখীউড়া দ্বিমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ে। লেখা পড়ায় খুবই ভালো ছিল জিম্মি,সে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী বয়স ১৪ বছর দেখতেও খুব সুন্দরী সবার সাথে ভদ্র ব্যবহার করতো জিম্মি। গ্রামের ছোট বড় সবাই তাকে খুবই ভাল বাসতো। প্রতি দিন ২কিঃমিঃরাস্তা পায়ে হেঁটে কাশ বনের পাশ দিয়ে নদীতে খেয়া পার হয়ে বিদ্যালয়ে লেখা পড়া করার জন্য যেত জিম্মি আক্তার।
দিনটি ছিলো বুধবার ১৬ অক্টোবর ২০১৯ সাল প্রতি দিনের মতো সে দিনও বাড়ি থেকে বের হয়ে বিদ্যালয়ে যায় জিম্মি। এদিনটাই ছিল জিম্মির জিবনের বিদ্যালয়ে যাওয়ার শেষ দিন। সেই যে সকাল বেলা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল আর বাড়ি ফিরে এলো না জিম্মি। সন্ধ্যা হয়ে গেল জিম্মির কোনো দেখা নেই।
দিশেহারা হয়ে তার মা বাবা এ বাড়ি সে বাড়ি খুঁজতে লাগলেন।অনেক খুঁজা খুঁজি করেও কোনো সন্ধান পেলো না জিম্মির,নিরুপায় হয়ে গেল তারা। দুই দিন পর ১৮ অক্টোবর ২০১৯ ইং রৌমারী থানায় এসে একটি হারানো জিডি করেন জিম্মির বাবা। অবশেষে ১৯ অক্টোবর বিকেল বেলা স্থানীয় লোকজন সুখের চর গ্রামের ঘুঘুমারী চরের একটি কাঁশবনের কাছে মমতাজ আক্তার জিম্মির বই ও পায়ের ছ্যান্ডেল পড়ে আছে দেখতে পায় তারা, অতি তাড়াতাড়ি খবর পৌঁছায় জিম্মির বাড়িতে। খবর পেয়ে তার পরিবার,আত্মীয় সজন ও স্থানীয় লোকজন ছুটে য়ায় সেই কাঁশবনের ভেতরে। কাঁশবনের ভিতরে ঢুকেই তারা দেখতে পায় নিজের ওড়না দিয়ে হাত,পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় মমতাজ আক্তার জিম্মির লাশ পড়ে আছে। জিম্মির পরিবারের লোকজন রৌমারী থানায় খবর দিলে পুলিশ এসে জিম্মির লাশ উদ্ধার করে রৌমারী থানায় নিয়ে যায়।রৌমারী থানায় এ সংক্রান্তে একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়।
মামলার তদন্তভার দেয়া হয় রৌমারী থানায় কর্মরত এসআই আখতারকে।
এব্যাপারে কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার মহিবুল আলম খান জানান,ঘটনাটি স্পর্শকাতর হওয়ায় প্রথম থেকেই মামলার রহস্য উদঘাটনের জন্য আমি তাগাদা দিতে থাকি এই মামলার আইও আকতারকে। তাকে বলি আপনি জিম্মির বাড়িতে গিয়ে তার বই খাতা ভালোভাবে চেক করে দেখুন । তাতে কোনো নাম বা মোবাইল নাম্বর পাওয়া যায় কি না এমনতো হতে পারে তাকে ডিসটার্ব করা কোন ছেলের নাম বা মোবাইল নাম্বার তার খাতায় লিখা থাকতেও পারে। আমার কথা শুনে তদন্ত অফিসার আকতার হোসেন অতি দূরত্ব চলে যায় জিম্মির বাড়িতে খুঁজতে থাকে তার বই খাতা মিলেও যায় একটি নাম ও মোবাইল নাম্বার। আমরা আশান্বিত হয়ে উঠি।
তবে আইওকে বলি একেবারে নিশ্চিত না হয়ে কাউকে হত্যা মামলায় আসামি করে চালান দেওয়া যাবে না। এসআই আখতারও সূত্র খুঁজতে থাকে। প্রযুক্তির সহায়তায় বুঝতে পারি ঘটনার সময় উক্ত ব্যক্তি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না। একটু দমে যাই আমি। পরে রৌমারী থানার ওসি আবু মোঃ দিলওয়ার হাসান ইনামকে তাগাদা দিই যেভাবেই হোক জিম্মি হত্যার আসল খুনিদের শনাক্ত করতেই হবে।
এসআই আখতারও চালিয়ে যাচ্ছেন তদন্ত অভিযান হাল ছাড়েননি তিনি । টানা ১৭ দিন তিনি চর ঘুঘুমারীতে অবস্থান করতে থাকেন। থানা থেকে বেশ দূরে যোগাযোগ ও থাকার ব্যবস্থা একেবারেই নাজুক। তথ্য ও প্রমাণ খুঁজতে থাকেন। অবশেষে পেয়ে যান আসল তথ্য।
আমাকে জানালে প্রযুক্তিগত সহায়তা নেই আমার আগের ইউনিট সিটিটিসি, ডিএমপি থেকে। মিলেও যায় আসামিদের অবস্থান। এসআই আখতারকে নির্দেশ দিই আসামিদের গ্রেপ্তার করার। গ্রেপ্তার করা হয় নুরুনবী ও হামিদুলকে। অকপটে (আখতারের ভাষায়) তোতা পাখির মতো) হত্যার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকারও করেন তারা। বিস্মিত হই হামিদুলের কথায়, সে নিজে একজন প্রতিবন্ধী। কথা বলতে পারে না ঠিকমতো,শারীরিক সমস্যা রয়েছে। নিজেদের দায় পুরোপুরি স্বীকার না করে কৌশলে এড়িয়ে যেতে চায় তারা দুজন। তারা বলতে থাকে আমড়াই দুজন শুধু আসামি নই আরও তিনজন আছে জড়িত এই হত্যাকাণ্ডে। আমরা দুজন শুধু পাহারা দিয়েছে মাত্র,ঘটনা ঘটিয়েছে ওরা তিনজন। জিজ্ঞেস করা হয় তারা তিন জন কোথায় আছে, নুরনবী ও হামিদুল বলে বাকিরা ঘটনার পর থেকেই টাঙ্গাইল চলে গেছে ইটভাটায় কাজ করতে।
তাহলেতো সেখানে ফোর্স পাঠাতেই হবে, রৌমারী থানার ওসিকে বলি অতি দ্রুত টাঙ্গাইলে ফোর্স পাঠাতে। আমার কথা শুনে অতি তাড়াতাড়ি টাঙ্গাইলের ইটভাটায় ফোর্স পাঠিয়ে দিলেন ওসি, সাথে যায় জিম্মির পরিবারের সদস্যরা। নাম শুনেই খুনিদের চিনতে পারে তারা। চেহারা শনাক্ত করতেই তাদের পাঠানো হয়। অবশেষে ধরা পড়ে রমজান, রাজ্জাক ও দুখু মিয়া সবাইকে পাঠানো হয় জেলখানায় । সবার বাড়ি জিম্মির বাড়ির পাশেই। আমি ব্যস্ত বিভাগীয় পরীক্ষার খাতা দেখা নিয়ে, তবুও নিজে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম।
আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে জানায় রমজান ইতিপূর্বে জিম্মিকে প্রেম নিবেদন করলে জিম্মি তাতে সাড়া দেয়নি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সে অন্যান্যদের নিয়ে জিম্মিকে ধর্ষণ ও হত্যার পরিকল্পনা করে এবং ঘটনার দিন সকলে মিলে তা বাস্তবায়ন করে। এতে প্রতিবন্ধী হামিদুলই বড় ভূমিকা পালন করে।
এখনকার দিনে যে কোন মামলার রহস্য উদঘাটনে পুলিশ নানাভাবে প্রযুক্তির সহায়তা নেয়, এই মামলার ক্ষেত্রেও আমারাও সেভাবেই চেষ্টা করি, তবে মামলার রহস্য উদঘাটন হয় একেবারেই ভিন্নভাবে। ঘটনার পর আসামী নুরুন্নবীর ভেতর মানসিক পরিবর্তন দেখা দেয় , সে প্রায়ই ঘুমের ঘোরে কাশগড়( কাশবন) বলে চিৎকার করে উঠতো এবং এক পর্যায়ে নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে মায়ের বাসায় এসে ওঠে, বিষয়টা এলাকার অনেকেরই নজরে আসে। মানলার আইও দীর্ঘ ১৭ দিন ঐ এলাকায় অবস্থান করার কারনেই সেও বিষয়টি জানতে পারে, তা না হলে আরো অনেক মামলার মত একটা ফাইনাল রিপোার্টেই হয়তো মামলার সমাপ্তি ঘটতো।
এই মামলা তদন্তে সাফল্যর জন্য পুলিশ সুপারের তরফ থেকে এসআই আখতারকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।